Saturday, October 24, 2009

মুসলমানদের জীবনে রোজার কাঙ্খিত প্রভাব; রমজানের শিক্ষাসমূহ

রমজানের সময়কাল অনেকটা বিদ্যালয়ের মত, যে সময়টিতে শেখার মত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। কোন কারণে নামাজ কাজা হয়ে গেলে আমরা তা পরবর্তীতে আদায় করে নিতে পারি, কিংবা রোজাও পরবর্তীতে রাখতে পারি, কিন্তু রমজানের সময়টি সেরকম নয়। রমজানের গুরুত্বপুর্ণ শিক্ষাগুলো অর্জন ছাড়াই যদি এ মাসটি পার হয়ে যায় তবে তা একজন মুসলমানের জীবনে বিরাট ক্ষতি।

আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা বা তাকওয়া সৃষ্টি : রোজার মূল লক্ষ্য তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহ ভীতি এবং তাঁর সম্পর্কে সচেতনতা অর্জন। কুরআনের যে আয়াতে রোজার আদেশ দেয়া হয়েছে, সে আয়াতেই এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে: “হে বিশ্বাসীগণ। তোমাদের জন্য সিয়াম পালনকে নির্ধারণ করা হল যেমনটি তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” (সূরা আল বাক্বারাহ, ২: ১৮৩) এ তাকওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ নৈতিক গুণগুলোর একটি, তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে একজন মুসলিম আল্লাহর ক্রোধ এবং নিজের মাঝে একটি ঢাল তৈরী করতে পারে। তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহর সমস্ত আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকা, তাঁর উপস্থিতির উপলব্ধি, এবং এটা জানা যে তিনি আমাদের দেখছেন যা আমাদেরকে ব্যক্তিগত জীবনে উন্নততর মানুষ হতে সাহায্য করবে।

আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করা: বিভিন্ন ধরনের ইবাদত প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথে আমাদের বন্ধন প্রতিষ্ঠার উপায়। রমজানে এই ইবাদতগুলো পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, যেন আমরা এই মাস শেষে আল্লাহর সাথে সম্পর্কের উচ্চতর স্তরে অবস্থান করতে পারি। খাদ্য ও পানীয় দেহের পুষ্টির উৎস, মনের খোরাক হচ্ছে জ্ঞান, আর অন্তরের প্রয়োজন হচ্ছে ঈমান এবং আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা। রমজানে অধিক ইবাদতের দ্বারা আমরা ইবাদতকে আমাদের জীবনের মৌলিক কাঠামো হিসেবে গ্রহণের শিক্ষা পাই। কুরআনে যেমনটি বলা হচ্ছে: “...নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার ত্যাগ, আমার জীবন-মরণ, জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।”(সূরা আল আনআম, ৬:১৬২) এরকমই হচ্ছে একজন প্রকৃত মুসলমানের জীবন। রমজানে বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য এক মাসে কুরআন খতম করা নয়। বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর বাণীর সাথে আমাদের সম্পর্ক গভীরতর করা, যদি কুরআনের বাণী আমাদের অন্তরে স্থান করে নিতে পারে, তবে তা আমাদের জীবনকে আমূল পরিবর্তন করতে সাহায্য করবে। রমজানে বেশী করে রাতের নফল নামাজ আদায় করা, যেন রমজানের পরও তা আমাদের অভ্যাস হিসেবে থেকে যায়। তেমনি এ মাসে ধার্মিক লোকদের সাহচর্য লাভে সচেষ্ট হওয়া, রোজাদারদের সাথে বসে একসাথে ইফতার করা, এবং রোজাদারেরা একে অপরকে ইফতারের দাওয়াত দেয়া।

নিয়ন্ত্রণ: রোজা যেহেতু খাদ্য, পানীয় এবং যৌন বাসনা থেকে সংযম, তাই এর মাধ্যমে রোজাদারের আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলন হয়। আত্মিক সংযমও রোজার লক্ষ্য। কেবল খাদ্য, পানীয় ইত্যাদিই নয়, রোজাদারকে মিথ্যা বলা, গীবত করা, দুর্নাম করা ইত্যাদি থেকেও বিরত থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “যে রোজা অবস্থায় মিথ্যা বলা এবং মিথ্যার ওপর আচরণ করা থেকে বিরত হল না, তার ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” তিনি আরও বলেছেন: “তোমাদের কেউ রোজা অবস্থায় যেন অশ্লীল কাজ ও অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে বিরত থাকে, এবং যদি কেউ কোন অশ্লীল কথা শুরু করে কিংবা তর্ক করতে আসে, তবে সে যেন তাকে বলে: “আমি রোজাদার।” তাই উপরোক্ত দিক নির্দেশনা মেনে যে রোজা রাখবে, তার নৈতিক চরিত্রে উন্নতি ঘটবে, সে অধিকতর সত্যবাদী এবং কথা ও কাজে আরও সতর্ক হবে।

সহমর্মিতা: রোজা একজন মানুষকে ক্ষুধা এবং তৃষ্ণার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করায়, ফলে সে দরিদ্রের অবস্থা বুঝতে পারে। এর ফলে তার মাঝে দরিদ্রেকে সহায়তা করার এবং তাদেরকে নিজ সম্পদের ভাগ দেয়ার প্রেরণা সৃষ্টি হয়। আর এই চেতনার নমুনা হিসেবেই ঈদুল ফিতরের দিনে গরীবকে নির্দিষ্ট পরিমাণে দান করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

রমজান মাস আত্মরক্ষার মাস। এ মাস ধৈর্য, সহনশীলতা ও ইবাদতের মাস। সর্বোপরি, রমজানে পবিত্রতা অর্জন করে আখিরাতে মুক্তি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাস। তাই আমাদের উচিত এই পবিত্র মাসকে নিজেদের গড়ে তোলার প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে গ্রহণ করা, যাতে সেই প্রশিক্ষণ লব্ধ জ্ঞান দিয়ে বাকি ১১ মাস চলতে পারা যায়। আল্লাহ আমাদের সেই তৌফিক দিন, আমিন।

No comments:

Post a Comment